'' বাংলা সাহিত্যের আসর ''

যে সমস্ত লেখক ও লেখিকা ' বাংলা সাহিত্যের আসরে ' তাদের নির্বাচিত লেখা প্রকাশ করতে চান,তারা তাদের লিখিত বিষয় টি Microsoft Words - এ লিখে অথবা Photo Shop -এ চিত্রসহ বিষয়টি প্রস্তুত করে samarkumarsarkar@yahoo.co.in বা samarkumarsarkar@gmail.com -এ E-mail করে পাঠিয়ে দেবেন । সদস্য হবার জন্য ও মন্তব্য লেখার জন্য Google Friend Connect ব্যবহার করুন। ব্লগ টিকে আপনাদের Face Book-এ Share করুন।

Tuesday, June 18, 2013

গুরুদক্ষিণা - সমর কুমার সরকার / শিলিগুড়ি

গুরুদক্ষিণা

শ্বশুর মশাই জামাই কে কন বিয়ের পরে,
আড়ালেতে ডেকে অতি চাপা স্বরে-
"বুঝলে বাবা,সকল সুখের মূলে টাকা,
যার টাকা নেই,জানবে তার-ই জীবন ফাঁকা।
যেমন তেমন ক'রে পারো দু হাত ভরে,
কামাও টাকা,লুকিয়ে রাখো অন্ধকারে।
ব্যবসায়ের আসল কথাই চাই মুনাফা,
স্থান,কাল ও পাত্র বুঝে করবে রফা।
মন্ত্রী বলো,সান্ত্রী বলো,আমলা,নেতা,
সবারই এই টাকার উপর দুর্বলতা।
বুদ্ধি ক'রে ওদের মাথায় ভাঙলে কাঁঠাল,
পায়ের উপর পা গুটিয়ে কাটাবে কাল।"

শ্বশুর মশাই জামাই কে কন ছ মাস পরে,
"বাবা-মায়ের সাথে আছো কেমন করে ?

আজকালকার ছেলে হয়েও এ কি গেরো!
বাবা-মাকে আজও ভয়ে ভক্তি করো?
পৃথক হয়ে বানাও এবার নিজের বাড়ী,
পারলে পরে সঙ্গে কিনো নতুন গাড়ী।
প্রতিষ্ঠিত হতেই হবে,আসল কথা,
কেমন করে হবে এসব ? খাটাও মাথা।
মূর্খ যারা কাটায় মায়ের আঁচল তলে,
লোকে ভাবে,'এ যে ভীষণ ভাল ছেলে'।
আসলেতে তারাই গাড়ল,নিরেট বোকা,
হয় না মানুষ,রয় চিরদিন 'ধেড়ে খোকা'।"

শ্বশুর মশাই বছর ছয়েক পরে ফোনে
জামাইকে কন,"আনন্দ খুব হচ্ছে মনে।

বাবা মা কে ছেড়ে গিয়ে অনেক দূরে, 
বানিয়েছ বিশাল বাড়ী শ্রীরামপুরে।
তিন টা গাড়ীর মালিক তুমি এই ক' দিনে,

শিল্পপতি বলে তোমায় সবাই চেনে।
অনেক ভেবে,তোমায় এ বার বলছি শোনো,
পাল্টে ফেলো ঘরের জিনিস,যা পুরানো।

মূর্খ যারা,তাদের থাকে ফালতু বাতিক,
মায়ায় পড়ে এড়িয়ে চলে যুগের গতিক।
সফল হওয়া নয় কো সহজ, চাই মনে জোর,

দয়া-মায়ার স্থান দিয়ো না মনের ভিতর।"

বছর দশেক পরে জামাই তড়ি-ঘড়ি,
পাঠিয়ে দিলো গিন্নী কে তার বাপের বাড়ী।

সঙ্গে দিলো হাতে লেখা গোপন চিঠি,
তাতে লেখা,"বাবা,এবার চাইছি ছুটি।

বিয়ের পরে যা বলেছেন,সব শুনেছি,
আপন বিবেক,বাবা-মা কে ত্যাগ করেছি।

পুরানো সব পাল্টে নতুন জিনিস এনে,
নেশা আমার বাড়তে থাকে দিনে দিনে।

কে জানতো এমন নেশা সর্বনাশা?
অন্য নারীর সঙ্গে হলো ভালবাসা।

ঠিক করেছি,নতুন তাকেই আনব ঘরে,
শিক্ষা দাতা গুরু,দিয়েন ক্ষমা করে।।


*********************************
সমর কুমার সরকার / শিলিগুড়ি
*********************************






Friday, June 14, 2013

রম্যরচনা - "জামাই ষষ্ঠীর ইতিকথা" - সমর কুমার সরকার / শিলিগুড়ি

                               
রম্যরচনা


 জামাই ষষ্ঠীর ইতিকথা

জ্যৈষ্ঠ মাসের শুক্লা ষষ্ঠী তিথি আসন্ন। উপযুক্ত উষ্ণতা ও মৃত্তিকা রসের প্রভাবে প্রকৃতির যাবতীয় সন্তান উৎপাদনক্ষম আম,জাম,জামরুল,লিচু ও কাঁঠাল প্রভৃতি রসাল ও সুমিষ্ট ফলের বৃক্ষসমূহ স্বেচ্ছায় বা অনিচ্ছায় পতঙ্গ ঘটিত স্বাভাবিক পরাগ মিলনের কারণে দীর্ঘ গর্ভদশা শেষে শাখা প্রশাখার সুপক্ক ফল ভারে ন্যুব্জপ্রায়। গ্রাম,শহর ও নগরাদির লক্ষ-কোটি গৃহ প্রাঙ্গণ আম-কাঁঠালের সুমধুর সুবাসে সদা আমোদিত ।গৃহস্থগণের রসনা সুমিষ্ট আম-কাঁঠালের রসাস্বাদনে আপ্লুত ও আহ্লাদিত। এতদ সময় কালে ভারতবর্ষ স্থিত পশ্চিমবঙ্গ,আসাম এবং ত্রিপুরা, তৎসহ প্রতিবেশী রাষ্ট্র বাংলাদেশস্থ বঙ্গভাষী হিন্দু সম্প্রদায়ের মনুষ্যগণ আপন সন্তান কামনায়,বা পুত্র ও পুত্রবধূর সন্তান কামনায়,বা বিবাহিতা কন্যার সন্তান কামনায় ও সকল সন্তানদিগের সুখ,সমৃদ্ধি ও দীর্ঘায়ু  কামনায় মহোৎসাহে উৎপাদিকা শক্তির নিয়ন্ত্রী,মাতৃত্বের প্রতীক মহাদেবী ষষ্ঠীর আরাধনায় ব্রতী হন।

ধৈর্য ধরুন পাঠকগণ,উদ্বিগ্ন হইবেন না। জানি,আপনার মুখে মেঘলা দিবাবসানে  হঠাৎ দেখা এক ঝলক রৌদ্রের ন্যায় মৃদু হাসির আবির্ভাব ঘটিয়াছে। নিজের মনকে নিজেই ঠারেঠোরে প্রশ্ন করিতেছেন-"বিশাল রাষ্ট্র ভারতবর্ষ ও প্রতিবেশী রাষ্ট্র বাংলাদেশে কত প্রকার জাতি ও সম্প্রদায়ের মনুষ্যই না বাস করেন ? তাহাদিগের সকলেরই যদি ষষ্ঠী দেবীর কৃপা ব্যতীত সন্তান লাভ সম্ভব হয়,তবে কেবল মাত্র বঙ্গভাষী হিন্দুদিগের সন্তান লাভার্থে ষষ্ঠী পূজা আয়োজনের কারণ কি ?" আপনার জ্ঞাতার্থে জানাই,বাঙ্গালী হুজুগ প্রিয় জাতি হইলেও,একটি হাঁচি পর্যন্ত অকারণে হাঁচেন না। বঙ্গভাষী হিন্দুগণ যদি উচাটন ও বশীকরণ মন্ত্রের সহায়তায় পরস্ত্রী বা নিজ স্ত্রী কে প্রেমোন্মাদিনী ও কামপরায়ণা করিয়া তুলিতে পারেন,সাধু, মহাত্মাদিগের মন্ত্রপুত তৈল বা জল মাখাইয়া,বা চরণামৃত পান করাইয়া যদি ঘোর নপুংশক পতিদেবের সতীসাধ্বী স্ত্রীর গর্ভ সঞ্চার করিতে পারেন,তবে জননশক্তি তথা উৎপাদিকা শক্তির মূল নিয়ন্ত্রী মহাদেবী ষষ্ঠীর পূজাই বা করিবেন না কেন ? 

মহাদেবী ষষ্ঠীর বসতি অরণ্যাঞ্চলের বটবৃক্ষ তলে,এবং দেবীর বাহন মার্জার শ্রেষ্ঠ হুলো। কৌতুহলী পাঠক হয় তো প্রশ্ন করিবেন-"অরণ্যাঞ্চলে শত শত নানাবিধ বৃহদাকার ও ক্ষুদ্রাকার জানোয়ার থাকা সত্ত্বেও, দেবীর বাহন হুলো কোন বিবেচনায় ? পাঠক গণ,আমার নিম্নগামী জ্ঞানমার্গে বিচরণ করিয়া যে টুকু সার, সত্য উপলব্ধি করিয়াছি,তাহা এই রূপ- "বঙ্গভাষী হিন্দু জামাতাদিগের সঙ্গে বহু ক্ষেত্রেই মার্জার শ্রেষ্ঠ হুলোর ঘোরতর সাদৃশ্য  পরিলক্ষিত হয়। গৃহস্থের কষ্টার্জিত উপার্জনে ক্রীত দুগ্ধ বা দুগ্ধজাত ছানা, মাখন, ক্ষীর প্রভৃতি,বা মৎস্য ও মাংস খণ্ড হুলো কেমন চক্ষের নিমেষে নিঃশব্দে গলাধঃকরণ করে,তাহা আপনারা অবগত আছেন। এতদ্ব্যতীত সম্বৎসর লোকালয়ে হুলোদের সঙ্গে চাক্ষুষ সাক্ষাৎ না ঘটিলেও,প্রজনন ঋতুতে হুলোদের কোলাহল মুখর মিলন সঙ্গীত নিশ্চিত আপনাদের কর্ণ কুহরে প্রবেশ করিয়া উল্লাস বা ঘোরতর বিরক্তি সৃষ্টি করিয়া থাকে। লোকালয়ে মার্জারীগণ প্রতি বৎসর এই যে নিয়মিত একাধিক সন্তান প্রসব করিয়া  মার্জার কুলকে চক্রবৃদ্ধি হারে বর্ধিত করে, তাহা তো হুলোদের কৃপাতেই সম্ভব হয়। বঙ্গভাষী জামাতাগণ ও হুলোর ন্যায় প্রতি বৎসর নুলো ডুবাইয়া শ্বশুর মহাশয়ের কষ্টোপার্জিত মুদ্রা ব্যয়ে সংগৃহীত দুগ্ধ,ছানা,ঘৃত, মৎস্য,মাংস,পলান্ন,পরমান্ন প্রভৃতি নির্বিকার চিত্তে ভক্ষন করিয়া থাকেন। জীবনে প্রতিষ্ঠিত হউন বা না হউন,নির্লজ্জ হুলোর মতই তাহারা সম্ভব হইলে প্রতি বৎসরেই সন্তান উৎপাদনে উৎসাহ বোধ করেন। যে হেতু বঙ্গভাষীর ষষ্ঠী পূজায় জামাতাদিগের উপস্থিতি অনিবার্য,তাই ষষ্ঠী দেবীর বাহন নির্বাচন আমার মতে যথার্থ বলিয়াই মনে হয়।


উৎপাদিকা শক্তির নিয়ন্ত্রী,দেবী ষষ্ঠী ষষ্ঠভূজা। দেবীর দুই হস্তে মঙ্গলঘট,এক হস্তে অসি,এক হস্তে বর্ম,এক হস্তে অভয় মুদ্রা,এক হস্ত সর্বদা কোন না কোন শিশুকে ক্রোড়ে বেষ্টন করিয়া রাখে।দেবীর কাঁখে ও ক্রোড়ে সন্তানের দল।কাতর কণ্ঠে কেহ দেবীর নিকট সন্তান প্রার্থনা করিলেই,দেবী বৈধ বা অবৈধ যে কোন পন্থা অবলম্বন করিয়া তাহাকে সন্তান প্রদান করেন। ভাবিয়া দেখুন,সৃষ্টি শক্তির অধিষ্ঠাত্রী দেবী ষষ্ঠীর হস্তেও অসি ও বর্ম,ইহার হেতু কি ? অর্থাৎ সন্তান উৎপাদন কার্যে বাধার সৃষ্টি হইলে,সে যত বড় শক্তিই হউক, দেবী প্রয়োজনে তাহাকে দমন করিয়া আপন মহিমা অমলিন রাখিবেন।অতএব পাঠকগণ,যদি কাহারও মনে বিন্দুমাত্র বাসনা থাকে,দশ পনের টি শিশুর পিতা বা মাতা হওয়ার দুর্লভ গৌরব অর্জন করিবেন,তবে দেবী ষষ্ঠীর শরণাপন্ন হউন,সুফল অবশ্যম্ভাবী।

জ্যৈষ্ঠ মাসের শুক্লা ষষ্ঠী তিথিতে সধবা মহিলারা প্রত্যুষে স্নান সমাপনান্তে একক রূপে অথবা মিলিতভাবে একটি ডালায় ছয় প্রকারের ফল,ছয় গাছা সূত্র,ছয় টি পান,ছয় টি সুপারি,বাঁশ পাতার কোঁড়, হরিদ্রা রঞ্জিত বস্ত্রখণ্ড,চিড়া,দই,খই,তৈল,হরিদ্রা চুর্ণ,সিঁদুর,ধান্য,দূর্বা,ব্যজনী ও জলপূর্ণ ঘট সহ বটবৃক্ষ তলে,অথবা কোন পূজা মণ্ডপে বা আপন গৃহে বটশাখা স্থাপন করিয়া তাহার পাদদেশে ষষ্ঠীপূজার আয়োজন করেন। পূজা সমাপনান্তে মায়েরা সন্তানদের ললাটে তৈল-হরিদ্রার তিলক,ও হস্তে হরিদ্রা রঞ্জিত সূত্র বন্ধন শেষে, ব্যজনী দ্বারা বাতাস করিয়া,বাঁশপাতার কোঁড় ও দূর্বার আঁটি মঙ্গল ঘটের জলে ডুবাইয়া, "ষাট ষষ্ঠীর ষাট, ষেটের কোলে বাছা আমার চিরসুখে থাক"- এই বাক্য বলিতে বলিতে মস্তকে ও সর্বাঙ্গে জল সিঞ্চন করেন। তৎ পরে মায়েরা সকলে ষষ্ঠীর ব্রতকথা শ্রবণ করেন ও ষষ্ঠীর বাহন কে পরমান্ন ভোজনে তৃপ্ত করিয়া নিজেরা ফলাহার করেন। এইরূপ ষষ্ঠী পূজা অরণ্য ষষ্ঠী নামেই সুবিদিত।


পুরুষ শাসিত হিন্দু সমাজ ব্যবস্থায় শাস্ত্রের অধিকাংশ বিধানই পুরুষ জাতির স্বার্থরক্ষায় রচিত। যে বঙ্গভাষী সমাজ ব্যবস্থায় কন্যাকে বিবাহ করিবার পারিশ্রমিক স্বরূপ বা উৎকোচ বাবদ জামাতাকে বাড়ী,গাড়ী,আসবাবপত্র,বিলাস দ্রব্য,মায় নগদ টাকা প্রদানের জন্য কন্যার পিতাকে সর্বস্বান্ত হইতে হয়, সেই বঙ্গভাষী জামাতা পুরুষগণ বিনা পারিশ্রমিকে বা বিনা উৎকোচে অপরের কন্যার গর্ভে সন্তান উৎপাদনের প্রাথমিক কার্যটির পরিশ্রম স্বীকার করিবেন কেন ? তাই বঙ্গভাষী শ্বশুর ও শ্বশ্রূমাতাগণ আপন জামাতাদিগের সন্তোষ বিধানার্থে,বা আপন কন্যাকে মাতৃরূপে প্রতিষ্ঠিতা করিবার মানসে,কিংবা দৌহিত্র-দৌহিত্রীর মুখদর্শন করিয়া অক্ষয় স্বর্গলাভের অভিলাষে অরণ্য ষষ্ঠীর মত একই বিধিমতে কন্যা ও জামাতা সমভিব্যাহারে আপন গৃহে ষষ্ঠী দেবীর আরাধনা করেন,যাহা জামাই ষষ্ঠী রূপে সমধিক পরিচিতি ও প্রসিদ্ধি লাভ করিয়াছে।


জামাই ষষ্ঠী পালনের জন্য শ্বশ্রূমাতা ঠাকুরাণীদের কতকগুলি বিশেষ বিধি পালন করিতে হয়। ষষ্ঠী পূজা সমাপনান্তে জামাতাকে আসনে বসাইয়া শ্বশ্রুমাতা বারংবার ব্যজনী সঞ্চালন করিয়া জামাতার দেহ শীতল করেন। তৎপরে মঙ্গলদীপ দ্বারা জামাতা কে বরণ করিয়া ধান্য,দূর্বা সহযোগে জামাতা কে আশীর্বাদ করেন এবং মনে মনে দেবী ষষ্ঠীর নিকট প্রার্থনা করেন,যেন দেবীর কৃপায় জামাতা কন্যাকে সুখে রাখেন,ও মাতৃত্ব দানে পূর্ণ করেন। তৎপরে পূজার ঘট  হইতে জামাতার মস্তকে ও সর্বাঙ্গে ' ষাট ষষ্ঠী'র জল সিঞ্চন করিয়া শ্বশ্রুমাতা জামাতার হস্তে নানাবিধ উপহার সামগ্রী প্রদান করেন। এই উপহার সামগ্রীর মধ্যে জামাতার জন্য  ধুতি,পাঞ্জাবি,চাদর,শার্ট, শাল,কোট -প্যান্ট প্রভৃতি যেমন থাকে,তেমন ই ক্ষেত্র বিশেষে পারফিউম, সোনার হাত ঘড়ি, হীরার আংটি,চূণীর লকেট ,এমন কি আইপড বা ল্যাপটপ ও থাকিতে পারে। জামাতা বাবাজী আড়চোখে প্রাপ্ত উপহার সামগ্রীর উপর দৃষ্টি সঞ্চালন করিয়া মনে মনে উপহারের আনুমানিক মূল্য নিরুপণ পূর্বক গদগদ চিত্তে শ্বশ্রূমাতাকে প্রণাম নিবেদন করেন। উপহার যত মহার্ঘ হয়,জামাতার ভক্তি পূর্বক প্রণাম ও গদগদ চিত্তের চওড়া হাসি তত দীর্ঘ হয়। অনেকেই বলিতে পারেন,এমন আবার হয় না কি ?  ভাবিয়া দেখুন,আমি বা আপনি যেমন কাহারও জামাতা,তেমনি আমাদের শ্বশুরগণ ও কাহার ও না কাহার ও জামাতা, আবার আমার বা আপনার পিতা,পিতামহ বা তাহাদের শ্বশুর গণ ও কাহারও না কাহার ও জামাতা। অতএব বংশানুক্রমিক অভিজ্ঞতা বলে এবং বিবর্তনবাদের প্রাকৃতিক শিক্ষার গুণে নিশ্চয় হৃদয়ঙ্গম করিয়াছেন, গেঞ্জি উপহার প্রাপক আর পাঞ্জাবি উপহার প্রাপকের হাসি একই প্রকারের হওয়া সম্ভব নয়। আবার ধুতি পাঞ্জাবী প্রাপক জামাতা আর সোনার ঘড়ি,বা হীরার আংটি বা ল্যাপটপ প্রাপক জামাতার ভক্তি গদগদ হাসি কিছুতেই এক রকম হওয়া সম্ভব নয়।


জামাই ষষ্ঠীর সকালে  ষষ্ঠী পূজা সম্পন্ন হইলে প্রথম পর্যায়ে জামাতাদিগের জন্য লঘু ভোজনের ব্যবস্থা করা হয়। একটি বড় রেকাবীতে আম,জাম,জামরুল,লিচু,কাঁঠাল প্রভৃতি ফল,এবং অপর থালায় ঘন দুধের ক্ষীর,দই,খই,বিবিধ প্রকার মিষ্টি,সন্দেশ প্রভৃতি সুন্দর ভাবে সজ্জিত অবস্থায় পরিবেশিত হয়। চতুর জামাতাগণ জানেন যে,দুপুরে যেসব মহার্ঘ ভোজনের আয়োজন করা হইতেছে,তাহা উদরস্থ করিতে হইলে উদরে যথেষ্ট শূণ্য স্থান প্রয়োজন,উপরন্তু ক্ষুধাকে কিছুতেই স্তিমিত করা চলিবে না। তাই তাহারা পক্ষীর ন্যায় ফলের রেকাবিতে দুই একটি ঠোক্কর মারিয়া,বাছাই করা বিশেষ কিছু মিষ্টি বা সন্দেশ উদরসাৎ করিয়া ক্ষান্ত হন। জামাইষষ্ঠীর দিন যে মধ্যাহ্ন ভোজনের আয়োজন করা হয়,তাহার সমস্ত পদ-ই শ্বশ্রুমাতারা রন্ধন করিয়াছেন - এইরূপ বলিয়া থাকেন, কিন্তু বাস্তবে তাহা সম্ভব নয়। বিভিন্ন রমণীকে বিভিন্ন পদ রন্ধনের দায়িত্ব দেওয়া হয়। তাহাদের রন্ধন কালে,শ্বশ্রুমাতা সবগুলি পদের রন্ধন পাত্রেই কিছুক্ষণের জন্য খুন্তি নাড়েন মাত্র। মধ্যাহ্ন ভোজন কালে জামাতাদিগকে যে খাদ্য পরিবেশন করা হয়,তাহারও এক অদ্ভুত রীতি আছে। একটি বৃহৎ কাংস্য নির্মিত ঝকঝকে থালায় মিহি বাঁশমতি বা গোবিন্দভোগ চাউল হইতে প্রস্তুত সুগন্ধি অন্ন থালার মধ্যভাগে চূড়াকৃতিতে সজ্জিত থাকে । চূড়ার উপরিভাগে একটি ক্ষুদ্র বাটি খাঁটি গব্য ঘৃতে পরিপূর্ণ থাকে। থালার চতুর্দিকে মণ্ডলাকারে সজ্জিত বৃহৎ কাংস্য নির্মিত বাটিগুলির কোনটি তে থাকে সোনা মুগের ডাল, কোনটিতে চিতলের পেটি,কোনটিতে সরিষা ইলিশ ভাপা,কোন টিতে গলদা র মালাইকারি,কোন টিতে বা কচি পাঁঠার মাংস। হরেক প্রকার চীনামাটির পাত্রের কোনটি তে থাকে আম বা আনারসের চাটনী,কোনটিতে দই,কোন টি তে বা কাঁচাগোল্লা ও কড়া পাকের সন্দেশ। জামাতাগন স্বভাববশতঃই প্রথমে বিস্তর অভিযোগ জানান,এত প্রকার পদের আয়োজন করার কি দরকার ছিল ? এত প্রকার পদ কি একজনের পক্ষে খাওয়া সম্ভব ? শ্বশ্রুমাতা মিটিমিটি হাসিয়া বলেন,"না,না,এ আর তেমন কি আয়োজন !!! [ মনে মনে বলেন,ঢের দেখেছি বাছা,থালায় তো কোনদিনই কোন কিছু  পড়িয়া থাকিতে দেখি নাই।] জামাতাগণ মুখে বলেন বটে,এত প্রকার পদ খাওয়া অসম্ভব,কিন্তু অদ্ভুত যাদুমন্ত্রবলে একে একে সমস্ত পদ নিঃশেষিত হয়।


প্রাচীন বঙ্গভাষী হিন্দু সমাজে জামাইষষ্ঠী উপলক্ষ্যে গৃহে আগত জামাতাদিগ কে শ্বশ্রূমাতাগণ যেমন সাধ্যাতীত আদর অপ্যায়ন করিতেন,তেমন ই জামাতা ইচ্ছাপূরণে ব্যর্থ হইলে অর্থাৎ শ্বশ্রুমাতাকে দৌহিত্র    বা দৌহিত্রী উপহারে ব্যর্থ হইলে তাহার আদর ও মান সন্মান ক্রমশঃ হ্রাসমান হইত। এমনই একটি গল্প আপনাদের কাছে নিবেদন করিব। এই গল্পের কতখানি অংশ সত্য,বা কতখানি অংশ লেখকের কল্পনা প্রসূত তাহা নির্ণয়ের চেষ্টায় বিরত থাকিয়া গল্পকে না হয় গল্পের দৃষ্টিতেই দেখুন।
প্রাচীন কলিকাতা নিবাসী এক গৃহস্থ কোন এক সময়ে ভাগ্যের বিড়ম্বনায় তাহার পরম সুন্দরী কন্যা কে হুগলী জেলার কোন এক অজ পাড়াগাঁয়ের এক দরিদ্র পরিবারে পাত্রস্থ করিয়াছিলেন। বিবাহের কয়েক মাস পরেই প্রথম জামাইষষ্ঠী তে ঐ গৃহস্থের কন্যা ও জামাতা নিমন্ত্রিত হইয়াছিলেন। গৃহস্থ পত্নী নতুন জামাতা কে যথাবিধি মান্যতা সহ  ধান্য ও দূর্বা দ্বারা আশীর্বাদ করিয়া  নানা স্নেহসূচক বাক্যে তাহার প্রীতি বর্ধন করিলেন। মধ্যাহ্নে মহার্ঘ  উপাদেয় ভোজ্যবস্তু দ্বারা তাহাকে অপ্যায়িত করিলেন এবং জামাই ষষ্ঠীর আশীর্বাদী স্বরূপ জামাতাকে এক জোড়া জুতা,ধুতি,পাঞ্জাবি ও গাত্রবস্ত্র অর্থাৎ চাদর উপহার দিলেন।জামাতা ও কন্যার বিদায় কালে গৃহস্থ পত্নী পুনরায় তাহাদের আশীর্বাদ করিয়া বলিলেন-"সামনের জামাই ষষ্ঠীতে অবশ্যই সন্তান কোলে লইয়া আসিবে।"

বর্ষকাল পরে দ্বিতীয় বার কন্যা ও জামাতা জামাই ষষ্ঠীতে নিমন্ত্রিত হইলেন। ঐ জামাতার ঘোরতর আর্থিক অনটন ছিল এবং তিনি ছিলেন দূরদৃষ্টি সম্পন্ন। তিনি হয়তো ভাবিয়াছিলেন - "আমার যা স্বল্প রোজগার,তাহাতে দুই জনেরই অন্নের সংস্থান হয় না,সন্তানের জন্ম হইলে কোনক্রমেই তিন জনের ব্যয় সংকুলান হইবে না।শ্বশ্রুমাতা দৌহিত্রের মুখ দর্শন করিতে চাহেন তো আমার কি ? তাহার সাধ পূরণের সংকল্পে আমি কেন সংকটাপন্ন হইব?" তাই তিনি সন্তানের জন্ম যাহাতে কোনমতেই সম্ভব না হয়,সেই বিষয়ে যথেষ্ট যত্নবান ছিলেন। কন্যা ও জামাতাকে গৃহস্থ পত্নী এইবারেও যথেষ্টই অপ্যায়িত করিলেন। মধ্যাহ্নের ভোজ্যসকল পূর্বাপর উপাদেয় ও লোভনীয়ই ছিল। কেবল জামাই ষষ্ঠীর আশীর্বাদীতে পূর্বের ন্যায় এক জোড়া জুতা,ধুতি ও পাঞ্জাবি থাকিলেও গাত্রবস্ত্র অর্থাৎ চাদর অনুপস্থিত ছিল। আর ধান্য-দূর্বাদি দ্বারা জামাতা কে আশীর্বাদ কালে শ্বশ্রূমাতা কিঞ্চিত মলিন বদনে শুধু মাত্র জামাতা শুনিতে পায় এমন অনুচ্চ স্বরে মন্ত্র আওড়ানোর কায়দায় পুত্রবৎ জামাতাকে তিরস্কার করিলেন -
"সন্তানহীন, গেছো বাঁদর,
বাদ গেল তোর গায়ের চাদর।"
কেবল মাত্র জামাতা বাবাজী ই বুঝিতে পারিলেন,শ্বশ্রুমাতাকে দৌহিত্রদানের অক্ষমতার দণ্ডস্বরূপ তাহার প্রাপ্তি হইতে চাদর বাদ গেল। এবারেও বিদায় কালে শ্বশ্রুমাতা আশীর্বাদের সময় বলিলেন-"সামনের জামাই ষষ্ঠীতে অবশ্যই সন্তান কোলে লইয়া আসিবে।"
যথাবিধি বর্ষ গতে তৃতীয় বার কন্যা ও জামাতা জামাই ষষ্ঠীতে নিমন্ত্রিত হইলেন। কন্যা ও জামাতা কে গৃহস্থ পত্নী যথাবিধি অপ্যায়িত করিলেও, এবারের মধ্যাহ্ন ভোজে দুই একটি মহার্ঘ উপাদেয় পদের ঘাটতি ছিল। অবশ্য গৃহস্থ পত্নী দোষ খণ্ডন হেতু বারে বারেই ব্যক্ত করিলেন,তাহার শরীরটা না কি বেশ কয়েক দিন ধরিয়াই অসুস্থ। এবারে জামাই ষষ্ঠীর আশীর্বাদীতে শুধু এক জোড়া জুতা ও একটি ধুতি ছিল। চাদর তো আগের বৎসরেই বাদ পড়িয়াছিল,এবারে বাদ গেছে পাঞ্জাবি। এবারে শ্বশ্রুমাতা ছায়াঘন বদনে ধান্য-দূর্বাদি দ্বারা আশীর্বাদ কালে জামাতাকে পূর্বোক্ত ভঙ্গীতে তিরস্কার করিলেন-
"ছেলে আমার হয় না মামা,
বাদ গেল তোর গায়ের জামা।"
জামাতা বাবাজী মনে মনে বলিলেন,"অদৃষ্টের কি পরিহাস,শ্বশ্রুমাতার পুত্র মামা হইতে পারে নাই,অর্থাৎ তাহার ভগিনীর কোন সন্তান জন্মে নাই,সেই অপরাধে আমার প্রাপ্তি হইতে পাঞ্জাবি বাদ গেল। চাদর বাদ গিয়াছে,পাঞ্জাবি বাদ গেল,না জানি অদৃষ্টে আরও কত দুর্ভোগ আছে।" এবারে বিদায় কালে শ্বশুর মহাশয় বারংবার জামাতাকে বলিলেন,"তোমার শরীর টা কেমন দুর্বল দেখিতেছি বাবাজী,চিকিৎসকের পরামর্শ মত চলিয়ো।" পিতৃবৎ শ্বশুর মহাশয়ের পক্ষে এর বেশী কিছু বলা সম্ভব নয়। শ্বশ্রুমাতা আশীর্বাদের সময় শ্লোক কটিয়া বলিলেন-
" সবার কপাল সোনায় মোড়া,
আমার জুটেছে বেতো ঘোড়া।
সামনের জামাই ষষ্ঠীতে অবশ্যই সন্তান কোলে লইয়া আসিবে।"
এববিধ সব বাক্য শ্রবণে জামাতা মর্মাহত হইলেন। ভাবিলেন,আর শ্বশুরালয়ে আসিবেন না। কিন্তু বাস্তব বড় রূঢ়,সন্মানের ধার ধারিলে তাহাকে আরও সঙ্কটে পড়িতে হইবে। এই দুর্মূল্যের বাজারে এক জোড়া জুতা ও একটি ধুতির মূল্য কম নহে। আপন রোজগার হইতে এতগুলি টাকা খরচ করা তাহার সাধ্যাতীত।
জীবনে হতাশ হইলে জগৎ মিথ্যা। যত দিন মানুষ বাঁচে,আশা লইয়াই বাঁচে। তাই চতুর্থ বার কন্যা ও জামাতা জামাই ষষ্ঠীতে নিমন্ত্রিত হইলেন। ভাঙ্গা চেয়ার টেবিলের পায়াটিও কোন গৃহস্থ মায়াবশতঃ ফেলেন না কখন কোন কাজে লাগে বলিয়া,আর  এ তো জামাই বলিয়া কথা ! গৃহস্থ পত্নী যথারীতি জামাতাকে অপ্যায়িত করিলেন।শ্বশ্রুমাতার শরীর আর সারে নাই,তাই আয়োজনে এবারে ও ঘাটতি ছিল।এবারে জামাই ষষ্ঠীর আশীর্বাদীতে শুধু এক জোড়া জুতা পাওয়া গেল। প্রাপ্তি হইতে ধুতি বাদ গিয়াছে।শ্বশ্রুমাতা নির্লিপ্ত ভাবে ধান্য-দূর্বাদি দ্বারা আশীর্বাদ কালে জামাতাকে চাপা স্বরে তিরস্কার করিলেন-
"নপুংসক,মদ্দা হাতি,
বাদ গেল তোর পাছার ধুতি।"
জামাতা বাবাজী মনে মনে বলিলেন, "এ তো জানা কথাই,দণ্ড কেবল বাড়িয়াই চলিবে। তাই বলিয়া আমি পরের সুখের কারণে আত্মবলি দিতে পারিব না।" এবারে বিদায় কালে শ্বশুর মহাশয় বারংবার জামাতাকে উপদেশ দিলেন,"সময়ের কাজ সময়ে না করিলে পরে পস্তাইতে হয় বাবাজী,তুমি বুদ্ধিমান,তোমাকে অধিক বলা অশোভন।" শ্বশ্রুমাতা আশীর্বাদের সময়  শ্লোক কাটিয়া বলিলেন-
"পুরুষ যারা, নড়েচড়ে-
মেদিমুখো ডরে মরে।

সামনের জামাই ষষ্ঠীতে অবশ্যই সন্তান কোলে লইয়া আসিবে।" 
জামাতা মনে মনে বলিলেন, "আপনি মেদীমুখোই বলুন,আর যাই বলুন,আমার চিন্তাধারায় কোন রূপ পরিবর্তন হইবে না। আমি মেদিমুখো হইতে পারি,কিন্তু আপনার কন্যা আমার অঙ্গুলীহেলন ব্যতীত টুঁ শব্দ টি পর্যন্ত করিতে পারে না।"
কালচক্র নিয়ত ঘূর্ণায়মান, তাই আবার পঞ্চমবারের মত কন্যা ও জামাতা জামাই ষষ্ঠীতে নিমন্ত্রিত হইলেন। এবারের অপ্যায়নে আতিশয্য ছিল না,আর জামাতার জন্য কোন উপহারও ছিল না। শ্বশ্রূমাতা শুধু ধান্য-দূর্বাদি দ্বারা আশীর্বাদ কালে অনুচ্চ অথচ শ্লেষের স্বরে বলিলেন -

"ঠিক ধরেছি জামাই খুঁতো,
শেষ বাদ তোর পায়ের জুতো।"
জামাতা বাবাজী মনে মনে বলিলেন,"ভাবিয়াছিলাম,দণ্ড হইতে নিস্কৃতি নাই,কিন্তু একেবারেই শূণ্যহস্তে ফিরিতে হইবে,এইরূপ ভাবি নাই।" এবারে বিদায় কালে শ্বশ্রমাতা শুধুমাত্র শ্লোক কাটিয়া বলিলেন-
"যতই না হও পাহাড় চূড়া,
মুখ দেখে না আঁটকুড়া।"

সামনের জামাই ষষ্ঠীতে অবশ্যই সন্তান কোলে লইয়া আসিবে-এই কথাটি শ্বশ্রূমাতা আর বলিলেন না।
জামাতা মনে মনে বলিলেন,"শ্বশ্রূমাতা স্থিরনিশ্চিত হইয়াছেন,আমি পুরুষত্বহীন,তাই এবারে আর বলিলেন না যে,সামনের জামাই ষষ্ঠীতে সন্তান কোলে আসিয়ো। উপরন্তু জ্ঞাত করিলেন,যতই তুমি পাহাড়ের চূড়ার মত উঁচুদরের মানুষ হও,আঁটকুড়া অর্থাৎ নিঃসন্তান লোকের মুখ কেহই দেখিতে চাহে না।শ্বশ্রুমাতাকে দোষ দিয়া লাভ কি ? এইরূপ চিন্তা তো আমার আত্মীয় স্বজন,বন্ধুবর্গও করিতে পারেন।সত্য বলিতে কি,আমার ও তো পরীক্ষা হয় নাই,আমার পক্ষে সন্তানের জনক হওয়া সম্ভব কি না ? যতই কষ্ট হউক, সন্তানের পিতা হইতে না পারিলে আমি আর শ্বশুরালয়ে পদার্পণ করিব না।" অতএব গৃহে প্রত্যাগমন করিয়াই জামাতা সন্তানের জন্মের ব্যাপারে বিশেষ যত্নবান হইলেন। উদ্যমী পুরুষের চেষ্টা বিফলে যায় না। তাই পুনরায় জামাইষষ্ঠীর পূর্বেই জামাতা এক দেবশিশু তুল্য পুত্র লাভ করিলেন।


পরবর্তী বৎসরে আবার কন্যা ও জামাতা জামাই ষষ্ঠীতে নিমন্ত্রিত হইলেন। এবারে কন্যা আর শূণ্য ক্রোড়ে আসেন নাই,তাহার ক্রোড়ে এবার এক ফুটফুটে সুন্দর শিশুপুত্র। শিশুর জন্মের সংবাদ শ্বশ্রূমাতা পূর্বেই অবগত হইয়াছেন। তাই এবারের আয়োজনে প্রাচুর্যের ছড়াছড়ি। অতি উপাদেয় ও মহার্ঘ সব খাদ্য সম্ভার।শ্বশ্রুমাতা এইবারে পুলকের আতিশয্যে জামাতাকে বারংবার ব্যজনী দ্বারা বাতাস করিলেন। উৎফুল্ল বদনে জামাতাকে ধান্য-দূর্বাদি দ্বারা আশীর্বাদ করিয়া বলিলেন,"চিরসুখী হও বাবা। ষাট ষষ্ঠীর ষাট,এতদিনে আমার ষষ্ঠী পূজা সফল হইয়াছে।" আশীর্বাদী স্বরূপ জামাতাকে একজোড়া জুতা,ধুতি,পাঞ্জাবি ও চাদর তো দিলেন ই,অতিরিক্ত উপহার স্বরূপ দিলেন একটি ওজনদার কারুকার্য খচিত সোনার আংটি। জামাতা বাবাজী এতদিনের অপমান বিস্মৃত হন নাই। তাই পূর্বেই একটি চির কুটে কিছু লিখিয়া রাখিয়াছিলেন, শ্বশ্রূমাতাকে প্রণামের ছলে চিরকুট টি তাহার পদতলে রাখিয়া দিলেন। শ্বশ্রূমাতা পড়িয়া দেখিলেন,তাহাতে লিখা আছে -

"পাঁচ বছরে ঢের শিখেছি,বেশ হয়েছে জ্ঞান,
হয়নি ছেলে,অবহেলে,দাও নি আমায় মান।
যার কারণে ফিরে পেলাম সকল উপহার,
আশীর্বাদ টা তাকেই ক'রো,জানাই নমস্কার।
নইতো আমি নপুংসক,নই তো আর আঁটকুড়া,

সংসারেতে টানাটানি,তাই তো দেরী করা।
নাতি দেবে স্বর্গে বাতি,নিয়ো তাহার ভার।
কর্ম আমার হলো সারা,আসবো না কো আর।"
হতবাক শ্বশ্রুমাতা নিরুত্তর রহিলেন। কিন্তু জামাতার যে সন্মানবোধ জন্মিয়াছে,সেই কারণে অতিশয় প্রীত হইলেন।


প্রাচীন বঙ্গভাষী হিন্দু সমাজের সমাজ জীবন ছিল মন্থর ও কর্মবিমুখ। কন্যাদায়গ্রস্ত গৃহস্থগণের জীবনের মূল উদ্দেশ্যই ছিল যে কোন উপায়ে কন্যা কে পাত্রস্থ করা। তাই পাত্র জীবিকা বিহীন হইলেও পাত্রীর অভাব হইত না।ফলে কর্মহীন,উপার্জনহীন জামাতায় সমাজ পরিপূর্ণ ছিল। এই সব জামাতাগণের অধিকাংশই শ্বশুরালয়ের দাক্ষিণ্যে সংসার প্রতিপালন করিতেন। হতদরিদ্র কোন কোন জামাতা জামাই ষষ্ঠী উপলক্ষ্যে একবার শ্বশুরালয়ে আসিবার সুযোগ পাইলে সহজে আর গৃহে প্রত্যাগমনের নাম করিতেন না। পুত্রবৎ জামাতা আপন ইচ্ছায় শ্বশুরালয় পরিত্যাগ না করিলে,তাহাকে তো আর বলা যায় না -'অনেক দিন হইল,এবার আপনার গৃহে যাও', তাই অনেক ক্ষেত্রেই ভদ্রতা বজায় রাখিয়া  জামাতা বিতাড়নের নানা কৌশল অবলম্বন করিতে হইত। দেবভাষা সংস্কৃতে চারি পংক্তির একটি শ্লোকের মাধ্যমে এইরূপ একটি কাহিনী অতি সংক্ষিপ্ত আকারে বর্ণিত হইয়াছে। সংস্কৃত ভাষার বিলুপ্তির ফলে শ্লোক টি বিস্মৃতির অতলে নিমজ্জিত হইলেও,শ্লোকের একটি ক্ষুদ্র অংশ মনুষ্যগণ না জানিয়া বুঝিয়াই বলিয়া থাকেন। কোন ব্যক্তিকে তাহার অনুচিত কৃতকর্মের কারণে উত্তমমধ্যম প্রহার কালে অনেকেই আপন জ্ঞান প্রকাশের সহজ কামনায় "প্রহারেণ ধনঞ্জয়ঃ" বাক্যাংশটি বারংবার বলিয়া থাকেন।আপনাদের জ্ঞাতার্থে শ্লোকটি নিবেদন করিতেছি,কেননা,ক্ষুদ্র শ্লোক টিই গল্পটির উৎস।সংস্কৃত শ্লোক টি এইরূপ -
"হবির্বিনা হরির্যাতি
বিনা পীঠেন মাধবঃ।

কদন্নৈঃ পুণ্ডরীকাক্ষঃ
প্রহারেণ ধনঞ্জয়ঃ।।
এক্ষণে গল্পটি বিবৃত করি।


প্রাচীন বঙ্গ সমাজে এক গৃহস্থ তাহার চারি কন্যাকে নিতান্ত নিরূপায় হইয়া চারি দরিদ্র পরিবারে পাত্রস্থ করিয়া ছিলেন। ঐ গৃহস্থ ছিলেন পরম বিষ্ণু ভক্ত। তাই নামের সহিত বিষ্ণুর নামের সাদৃশ্য আছে,কেবল মাত্র সেইরূপ পাত্রদের হস্তেই কন্যা সম্প্রদান করিয়াছিলেন। জামাতাদিগের মধ্যে জ্যেষ্ঠ জামাতার নাম হরি,মধ্যম জামাতার নাম মাধব,তৃতীয় জামাতার নাম পুণ্ডরীকাক্ষ,এবং কনিষ্ঠ জামাতার নাম ছিল ধনঞ্জয়। জামাতাদিগের সকলেই ছিলেন হতদরিদ্র এবং পরমুখাপেক্ষী। জামাই ষষ্ঠীর নিমন্ত্রণে একবার সপরিবারে শ্বশুরালয়ে প্রবেশের সুবর্ণ সুযোগ লাভ করিলে তাহাদের  কেহই আর সহজে আপন গৃহে প্রত্যাবর্তনে সচেষ্ট হইতেন না। ঐ গৃহস্থের আর্থিক অবস্থা অনুকূল থাকায় হাস্যমুখেই জামাতাদিগের আবদার রক্ষা করিতেন। কিন্তু এক বৎসরে ফসল ভাল না হওয়ায় গৃহস্থ যথেষ্ট আর্থিক ক্ষতির সন্মুখীন হইলেন। তথাপি কন্যা ও জামাতাগণ নিরাশ হইবে চিন্তা করিয়া জামাইষষ্ঠীতে সকল জামাতাকেই সপরিবারে নিমন্ত্রণ করিলেন। মহা সমারোহে জামাই ষষ্ঠী পালিত হইল। কিন্তু একে একে দিন গত হয়,সপ্তাহ গত হয়,মাস গত হয়,জামাতারা কেহই আপন গৃহে প্রত্যাগমনের উদ্যোগ গ্রহণ করেন না। আসলে প্রতিদিন নানাবিধ ব্যঞ্জন সহকারে সপরিবারে নিশ্চিত আহারের সংস্থান ত্যাগ করিয়া কেহই আর সহজে অনিশ্চিত জীবনে ফিরিতে চাহে না।সকল জামাতাই ভাবেন-অন্যেরা অগ্রে যাউক,আমি না হয় কিয়দ কাল পরে যাইব।ফসল না হইবার কারণে গৃহস্থ পূর্বেই দুর্দশাগ্রস্ত ছিলেন,এক্ষণে জামাতাদিগের কল্যাণে ক্রমাগত ঋণগ্রস্ত হওয়ায় পুত্রদের শরণাপন্ন হইলেন। পিতা ও পুত্রগণ সকলে গোপনে পরামর্শ করিয়া স্থির করিলেন,জামাতাদিগের কার কোন বিষয়ে দুর্বলতা আছে,তাহা অনুসন্ধান করিয়া কৌশলে বিতাড়নের ব্যবস্থা করিতে হইবে।
গৃহস্থের বাটী তে জামাতা অপ্যায়নের বিশেষ এক রীতি ছিল। জামাতারা সুবৃহৎ সুদৃশ্য কাষ্ঠাসনে বসিয়া আহার করিতেন। বৃহৎ কাংস্য নির্মিত থালায় পর্বতের চূড়ার মত সজ্জিত সুগন্ধী অন্নের শীর্ষদেশে একটি ক্ষুদ্র বাটিকা খাঁটি গব্যঘৃতে পূর্ণ থাকিত। থালা বেষ্টন করিয়া তিন চারিটি বৃহৎ কাংস্য বাটি তে নানাবিধ ব্যঞ্জন থাকিত,আর বৃহৎ কাংস্য নির্মিত গ্লাসে থাকিত পানীয় জল। একদিন জামাতারা আহারে বসিয়া লক্ষ্য করিলেন,অন্নের চূড়ায় ঘৃতের বাটি অনুপস্থিত। জ্যেষ্ঠ জামাতা হরির ঘৃতের প্রতি অত্যধিক দুর্বলতা ছিল, তাই অন্য জামাতাগণ আহারে প্রবৃত্ত হইলেও হরির আঁতে ঘা লাগিল। ক্রুদ্ধ হরি ঘোষণা করিলেন, জামাতা হইয়া ঘৃতবিহীন অন্ন ভক্ষণ করা তাহার পক্ষে সম্ভব নহে। সেই দণ্ডেই হরি পরিবার সহ শ্বশুরালয় পরিত্যাগ করিলেন। কিছুদিন পরে জামাতা গণ লক্ষ্য করিলেন,আহার্য দেওয়া হইয়াছে,কিন্তু বসিবার সুবৃহৎ কাষ্ঠাসন অনুপস্থিত। মধ্যম জামাতা মাধবের কাষ্ঠাসনের প্রতি দুর্বলতা ছিল,তাই পুণ্ডরীকাক্ষ ও ধনঞ্জয় মাটিতে বসিয়া আহারে প্রবৃত্ত হইলেও,অপমানিত মাধব রূঢ় স্বরে বলিলেন,জামাতা হইয়া ভৃত্যের ন্যায় মাটিতে বসিয়া আহার করা তাহার পক্ষে সম্ভব নহে। সেই দণ্ডেই মাধব পরিবার সহ শ্বশুরালয় পরিত্যাগ করিলেন। পুণ্ডরীকাক্ষ ও ধনঞ্জয় মাটিতে বসিয়াই আহার করিতে লাগিলেন,তাহাদের ঘৃতেরও প্রয়োজন নাই। কয়েক দিবস পরে পুণ্ডরীকাক্ষ ও ধনঞ্জয় লক্ষ্য করিলেন, তাহাদের যে অন্ন দেওয়া হইয়াছে,তাহা কীটদ্রষ্ট বদগন্ধ যুক্ত চাউলে প্রস্তুত হইয়াছে। ধনঞ্জয়  আহারে প্রবৃত্ত হইলেও  পুণ্ডরীকাক্ষ ক্রোধে অগ্নিশর্মা হইয়া বলিলেন,যে শ্বশুরালয়ে জামাতাকে কীটদ্রষ্ট বদগন্ধযুক্ত চাউলের অন্ন পরিবেশন করা হয়,সে গৃহে আহার করা তাহার পক্ষে অপমানজনক। সেই দণ্ডেই পুণ্ডরীকাক্ষ পরিবার সহ শ্বশুরালয় পরিত্যাগ করিলেন। ধনঞ্জয় মাটিতে বসিয়া সাধারণ থালায় কদর্য অন্নই শুধুমাত্র এক প্রকার ব্যঞ্জন সহযোগে আহার করিতে লাগিলেন। নানা কৌশলেও তাহাকে বিতাড়ন করিতে না পারিয়া একদিন শেষ চেষ্টা দেখিবার আশায় তাহাকে  পানীয় জল  ও কোনরূপ ব্যঞ্জন  ছাড়াই শুধুমাত্র কদর্য অন্ন দেওয়া হইল। একে কদর্য অন্ন,তদুপরি ব্যঞ্জনহীন । ধনঞ্জয় অন্ন দ্বারা গোলাকার কয়েকটি মণ্ড প্রস্তুত করিয়া আহারে প্রবৃত্ত হইলেন। শুষ্ক অন্নের মণ্ড কণ্ঠদেশে আবদ্ধ হওয়ায় এবং পানীয় জল না থাকায় শ্বাসরুদ্ধ হইয়া ধনঞ্জয় গোঁ গোঁ শব্দ করিতে লাগিলেন।শ্যালকেরা অন্তরালেই ছিলেন। তাহারা দ্রুতবেগে আসিয়া কণ্ঠদেশ মুক্ত করার আছিলায় ধনঞ্জয়ের ঘাড় ও গলদেশে কয়েকটি কিল ও চড় মারিলেন,তৎপরে গণ্ডদেশে সজোরে চপেটাঘাত করিয়া গ্রাম্য ভাষায় বলিলেন, "অনেক নাক কাটা,কান কাটা দেখিয়াছি,তোমার মত চোখের চামড়া ছাড়ানো লোক দেখি নাই।তুমি কোন আক্কেলে শুকনো মোটা ভাতের পিণ্ডি গিলিতে গেলে ?"
অতঃপর মাথায় মুখে জল দিয়া ও জল পান করাইয়া ধনঞ্জয় কে বিপন্মুক্ত করা হইল। কিন্তু শ্যালকেরা কিল,চড় মারিয়াছে,সেই অভিমানে ধনঞ্জয় অবশেষে পরিবার সহ শ্বশুরালয় পরিত্যাগ করিলেন।
সুখের কথা,পরবর্তী কালে আমন্ত্রণ জানাইলেও জামাতারা কেহই আর শ্বশুরালয়ে জামাই ষষ্ঠী তে আসিতেন না। পুঁথিগত বিদ্যা অপেক্ষা হাতে কলমে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা লাভের মূল্য তো  আর কম নয়!!  


দিন বদলের সঙ্গে সঙ্গে যুগেরও বদল হইয়াছে। মানুষের রুচি সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়া অতি দ্রুততম বেগে পরিবর্তিত হইয়াছে। আজ কাল আর আগের মত কর্মহীন, উদ্দেশ্যহীন,পরমুখাপেক্ষী হত দরিদ্র জামাতা দের দেখা যায় না। আজকাল সচ্ছল,অতি সচ্ছল,বা ধনকুবের  জামাতাদের সময়ের বড় অভাব।জামাই ষষ্ঠীর নামে একটি শ্রম দিবস সম্পুর্ণ নষ্ট করার কথা কেহ ভাবিতেই পারেন না। জামাতাদের অধিকাংশই আজকাল সন্ধ্যার পর হইতে শ্বশুরালয়ে যাত্রা শুরু করেন।শ্বশ্রূমাতারা আগের দিনে প্রত্যূষ হইতে দিবা দ্বিপ্রহর পর্যন্ত ফুরসত পাইতেন না ,সমস্ত দিন অগ্নিতপ্ত  হইয়া জামাতাদিগের জন্য একের পর এক ব্যঞ্জন রন্ধন করিতেন।গৃহের দাসী বাঁদীরা সমস্ত দিবস ভর কাংস্য নির্মিত ভারী ভারী বৃহদাকার সব থালা ,বাটি, গ্লাস, মাজিয়া ঘষিয়া চকচকে ঝকঝকে করিবার কার্যে ব্যস্ত থাকিত।আজকাল হালফ্যাশনের বোন চায়নার ডাইনিং সেট বা  স্টেনলেস স্টিলের হাল্কা বাসনের জৌলুস আছে,কিন্তু আভিজাত্য নাই। নামী দামী সব হোটেল,রেঁস্তোরা বা ক্যাটারার দের কল্যাণে আজ পছন্দ সই নানাবিধ মহার্ঘ ভোজ্যবস্তু  চাহিদা মত এবং সময় মত একদম হাতে গরম পাওয়া যায়। অনেকেই আজকাল নামী দামী হোটেল বা রেঁস্তোরায় পূর্বাহ্নেই আসন সংরক্ষন করিয়া রাখেন। সেখানেই জামাতাগণ শ্বশুর,শ্বশ্রূমাতা,স্ত্রী,পুত্র-কন্যাদি ও শ্যালক শ্যালিকা সহ পান ভোজন পর্ব সমাধা করিয়া আপন আপন গৃহে প্রত্যাবর্তন করেন।আজকাল উপহারের ক্ষেত্রেও প্রাচুর্যের ছড়াছড়ি। জামাতাদের ধুতি পাঞ্জাবি উপহারের সুন্দর প্রথা বিলুপ্ত প্রায়। কন্যারা থাকিলে,জামাতা ও থাকিবে,আর জামাতা থাকিলে জামাই ষষ্ঠী ও  থাকিবে। কিন্তু প্রভেদ এই যে,আজ আর বিপন্ন শ্বশুর বা শ্বশ্রূমাতাকে জামাই বিতাড়নের জন্য কৌশল অবলম্বন করিতে হইবে না।


                                                                                                                 *********সমাপ্ত***********  

                                                                                                               সমর কুমার  সরকার / শিলিগুড়ি